বাবা আর দুই দাদাকে হারিয়ে আজও বেঁচে আছি আমি,কিন্তু একদিনের জন্যেও ভুলতে পারিনা তাঁদের! - তপন ঘোষ ( Tapan Ghosh)
কোনো ভাবে সাঁতার দিয়ে কুলে গিয়ে কাঁদার মধ্যে যতদুর পারি ডুবে থাকলাম। হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাখলাম ৬ মাসের সেই শিশু সন্তানের, যাতে কান্নার শব্দে হায়নারা আবার ঘিরে ধরে রক্তলোভে।
তীর থেকে দেখলাম নৌকা মাঝ নদীতে লাট্টুর মত ঘুরে চলেছে।
![]() |
তপন ঘোষ ( Tapan Ghosh) |
তখন আমার বয়স নিশ্চিত ১৫ এর নিচে।
স্কুল ফাইনালের ছাত্র । একান্নবর্তী পরিবারের সদস্য ১৬।মধ্যবিত্ত পরিবার। আমরা তখন পূর্ব পাকিস্তান এর ৩য় বৃহত্তম খুলনা জেলার বাসিন্দা। চোখে স্বপ্ন পরীক্ষায় ভালো ফলাফল,হৃদয়ে স্বাধীনতা।এর ভিতর এলো ৭ মার্চ,উত্তাল জনসমুদ্রে দেশনায়ক বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষন কাঁপিয়ে দিল সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান, অবরোধ, মিছিল সব মিলে প্রস্তুত।এর মধ্যে এলো ভয়ংকর ম্যাসাকার কালো ২৫ মার্চ।সমগ্র ঢাকা শহর রক্তের নদী। সমগ্র দেশের ভেতর তখন প্রকাশ্যে, গোপনে চলছে প্রতিশোধের লেলিহান দাবালন। শহর খুলনায়ও ব্যতিক্রম নয়।
এর ভিতরই বরাবরের মতো শাশক চক্র হিন্দুদের শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করে ২৮ তারিখে গন্যমান্য ৫ জন হিন্দুকে প্রকাশ্যে রাইফেলের গুলিতে হত্যা করলো।শহর জুড়ে একটা ভীতি আগেই ছিলো, সেটা বেড়ে দাড়ালো আরো।শুরুহলো শহর ত্যাগের হিড়িক। খালি বাড়িকে নিজের মনে করে শুরু হলো লুটপাট।
আমি আমার (Tapan Ghosh hindu samhati )পরিবারকে বুঝিয়ে শহর ছেড়ে আশ্রয় নেই পাশেই বাগেরহাটের একটা গ্রাম পিলজংগ নওয়াপাড়ায়- এক আত্মীয় বাড়ি।আশ্রিত আর বাড়ি দিয়ে মোট সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৫০।প্রথম প্রথম একটা অন্য আনন্দ লাগা কাজ করলেও অচিরেই বোঝা গেল, আমরা বাঘ রেখে ঘোগের ঘরে ঢুকেছি।
![]() |
image source wikipedia |
বাংলাদেশের সব থেকে নির্যাতিত স্থান গুলির মধ্য বাগেরহাট ছিলো অন্যতম।লুটপাট হত্যার এক চারণভূমি তখন এলাকার প্রতিটি গ্রাম। আগুন ধরানো বাড়ি থেকে ধোঁয়ার কুন্ডলী দৃশ্য ছিলো নিয়মিত। এসবের মূল নেতা ছিলো বাগেরহাটের ত্রাস রজব আলী ফকির।ছিলো তার বিরাট বাহিনী। একদিন পাশে একবাড়ি খেতে বসেছি দল বেঁধে এসে ভাত ফেলে দিয়ে কাঁসার থালা গুলো নিয়ে, গোয়াল থেকে গরু খুলে নিয়ে চলে গেল।আমরা রইলাম নীরব দর্শক।
বুঝতে সময় লাগেনি, এখানেই যাত্রা গুটিয়ে যেতে হবে অন্য কোথা,অন্য কোনো খানে।নিরাপদ আশ্রয় একমাত্র ভারত। কোনো এক কাক ডাকা ভোরে দুটো বড় নৌকা করে শুরু হলো যাত্রা। প্রাথমিক বিপদের সংকেত এলো কিছুদুর যেতেই। নৌকা ঘিরে বেশ কিছু দুর্বৃত্ত, আমাদের মিষ্টি ভাষায় দিনের বেলায় পথে বিপদ হবে বলে পথরোধ করলো। ছলের কথা বিশ্বাস করে আমরা থেকে গেলাম স্হানীয় এক বাড়িতে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নেমে এলে,পুনরায় আমরা দুনৌকায় ভাগ হ'য়ে যাত্রা শুরু করলাম। নদীতে তখন জোয়ার,রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে জোয়ারের কলতানে নৌকা বয়ে চলে।চারিপাশে গাছ গাছালী, মাঝে মধ্যে করুণ আর্তনাদ আর বুলেটের গগন বিদারক শব্দ আমাদেরও স্তব্ধ করে রেখেছে। এভাবে ঘন্টা খানিক অতিক্রম হওয়ার পরপরই ছোট্ট একটা পানসি নৌকায় ৬/৭ জন এসে নৌকা থামাতে বলে।সকলেই সশস্ত্র তারা।নৌকা মাঝ দরিয়ায়।হলাম বাধ্য। শুধুমাত্র পরনের কাপড় ছাড়া সব লুন্ঠিন করে ওরা চলে গেলো,হয়তোবা অন্য নৌকার সন্ধ্যানে। আবার ছাড়া হলো নৌকা। ৩০ মিনিট পর আবার ফিরে এলো তারা,আবার নৌকা থামাতে হলো।বাবা বললেন সবই তো নিয়েছো আর কি?
মুখের কথা শেষ হবার আগেই গর্জে উঠলো ভয়ংকর ভাবে থ্রি নট থ্রি এর একটা বুলেট, ব্লাংক রেন্জ থেকে। মুখের শব্দ বাবার সেই ছিলো শেষ। পরপরই কোনো কথা না বলেই আবার ট্রিগার লক্ষ্য এবার আমার বড়দা।পাশেই তার স্ত্রী, কোলে ৬ মাসের প্রথম পুত্র সন্তান। কি ক্রন্দন রোল,আজও আমি কোনো কোনো রাতে ঘুম ভেঙে সে শব্দ শুনি। পরপরই মেঝদাকে ওরা টার্গেট করে টিপেছে ট্রি গার।
![]() |
image source wikipedia |
পরেক্ষনেই শুনতে পেলাম হৃদয় হীম হয়ে আসা সেই ধ্বনি, তপন কোথায়? বোঝা গেল,সব খবর নিয়েই তারা মাঠে।দেরী না করে,বড়দাদার ৬ মাসের সন্তান ছিনিয়ে নিয়ে আমি ঝাপ দিলাম নদীতে। আমার দেখা দেখি সাথে থাকা ২ টো বোনও নদীতে ঝাপ দিয়েছিল।
ঝাপ দেওয়ার শব্দ শুনে আর ভিতরের হাহাজারী তে তারা আর দেরী না করে সরে গেলো অন্য কোথাও প্রাণ সংহারে।
কোনো ভাবে সাঁতার দিয়ে কুলে গিয়ে কাঁদার মধ্যে যতদুর পারি ডুবে থাকলাম। হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাখলাম ৬ মাসের সেই শিশু সন্তানের, যাতে কান্নার শব্দে হায়নারা আবার ঘিরে ধরে রক্তলোভে।
তীর থেকে দেখলাম নৌকা মাঝ নদীতে লাট্টুর মত ঘুরে চলেছে। ভিতর থেকে কান্নার হাহাজারী মিশে যাচ্ছে কোনো এক অসীম শুন্যতায়।
(আমি সেই হতভাগ্য তপন (Tapan Ghosh),এখনো বেঁচে আছি সেই স্মৃতি নিয়ে, যা নিত্য আমায় খোঁচায়।)
বাবা, স্বর্গীয় শিশুবর ঘোষ।
বড়দা,স্বর্গীয় রঞ্জন ঘোষ।
মেঝদা,স্বর্গীয় দীলিপ ঘোষ।
শেয়ার করুন এবং নিচের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করুন