রবীন্দ্রনাথের চোখে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু
Rabindranath Tagore and Netaji Subhas Chandra Bose in Bengali
নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের চেয়ে বয়সে রবীন্দ্রনাথ ছত্রিশ বছরের বড় ছিলেন।
সুকমল দালাল
Rabindranath Tagore and Netaji Subhas Chandra Bose in Bengali |
https://www.sundaytimeskolkata.com/blog/Easy-by-Tapan-Tarafdar-6097941c3720c
https://banglalive.com/netaji-and-tagore/
নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের চেয়ে বয়সে রবীন্দ্রনাথ ছত্রিশ বছরের বড় ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রথম শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন মাত্র সতেরো বছর বয়সে। সেই সতেরা বছরের অপরিণত তরুণকে একবার চোখের সামনে দেখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দেখেছিলেন একচল্লিশ বছরে যুবাবয়সে কংগ্রেসের রাষ্ট্রপতির আসনে বসতে। তিরিশের দশকের সময় থেকে রবীন্দ্রনাথ সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক ক্রমবিকাশকে লক্ষ্য করেছেন এবং চমৎকৃত হয়েছেন।
‘দেশনায়ক’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, 'আজ তুমি যে আলোকে প্রকাশিত তাতে সংশয়ের আবিলতা আর নেই, মধ্য দিনে তোমার পরিচয় সুস্পষ্ট। বহু অভিজ্ঞতাকে আত্মসাৎ করেছে তোমার জীবন, কর্তব্যক্ষেত্রে তোমার যে পরিণতি তার থেকে পেয়েছি তোমার প্রবল জীবনীশক্তির পরিচয়। এই শক্তির কঠিন পরীক্ষা হয়েছে কারাদুঃখে, নির্বাসনে, দুঃসাধ্য রোগের আক্রমণে, কিছুতেই তোমাকে অভিভূত করেনি। তোমার চিত্তকে করেছে প্রসারিত। তোমার দৃষ্টিকে নিয়ে গেছে দেশের সীমা অতিক্রম করে ইতিহাসের দূর বিস্তৃত ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রনাথ সুভাষচন্দ্রের প্রবল জীবনীশক্তির প্রমাণ দেখেছেন। সুভাষচন্দ্রের দৃষ্টিতে গুরুদেব দেখেছিলেন দেশের সীমা অতিক্রম করা একটি বিস্তৃত ক্ষেত্র। সুভাষচন্দ্রের মুক্তিসাধনাকে স্বাগত জানিয়েছেন তিনি। গুরুদেব নিজেও এক মহান মুক্তিসাধক। তাঁর মানবসভ্যতার মূলে - এই মুক্তির কথাই আছে। এই মুক্তি সব কিছুর ঊর্ধ্বে। পশুত্বের বন্ধন থেকে মানুষের মুক্তি।
ইতিহাসের প্রেক্ষিতে জানা যায় ১৯৩১ সালে ২৬ জানুয়ারি স্বাধীনতার দ্বিতীয় বার্ষিকী পালন করতে সুভাষচন্দ্র পুলিশের লাঠির নির্মম আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে দারুনভাবে জখম হন। সুস্থ হয়ে জুলাই মাসে বন্যাত্রাণের সেবাকার্যে উত্তর ও পূর্ববঙ্গের সাধারণ গৃহহারা মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান। ১৬ সেপ্টেম্বর তাঁর ও যতীন্দ্রমোহনের আহ্বানে সত্তর বছর ব্যসেও রবীন্দ্রনাথকে ময়দানে এসে হিজলির হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাতে হল। রবীন্দ্রনাথ দেখলেন আইন অমান্য আন্দোলনের শুরুতেই সুভাষচন্দ্রকে কীভাবে ইংরেজ পুলিশ গ্রেফতার করল। তিনি জেলের মধ্য অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সেই সময় সুচিকিৎসার জন্য নিজ ব্যয়ে ইউরোপে গেলেন। সেখানে পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার আগেই লখনই অধিবেশনে ১৯৩৬ সালে যোগ দেওয়ার তাগিদে ভারতে এসেই আবার গ্রেফতার হলেন। রবীন্দ্রনাথ চুপ থাকতে পারলেন না। প্রতিবাদী কণ্ঠে বললেন, 'এ হল দেশের অসম্মান'। অসুস্থ সুভাষচন্দ্রকে প্রেরণা উৎসাহ দেবার জন্য সঞ্চয়িতা পাঠালেন। এইসব দেখে রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন বিশ্বভারতীকে আগামী দিনগুলিতে সচল ও সজীব করে রাখতে হয় গান্ধিজি, জওহরলাল নেহরুর পাশে সুভাষচন্দ্রেরও সাহায্য প্রয়োজন। একথা তিনি কলকাতার শ্রীনিকেতন শিল্পভাণ্ডারের উদ্বোধন উপলক্ষে তাঁর ভাষণে পুত্র রথীন্দ্রনাথের মাধ্যমে সুভাষচন্দ্রের কাছে অকপটে লিখে পাঠালেন। সুভাষচন্দ্রও আশ্বাস দিয়েছিলেন।
সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের গোষ্ঠদ্বন্দ্বের কোনা সমাধান না পেয়ে শেষ অবধি প্রেসিডেন্ট পদ ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে এই পদক্ষেপ দেশনায়ক করে দিল। তিনি লিখলেন, 'দুঃখকে তুমি করে তুলেছ বিঘ্নকে করেছে সোপান। জানুয়ারি ১৯৩৯ সালে শান্তিনিকেতনে বসে কংগ্রেস হিসেবে সুভাষচন্দ্রকে কলকাতায় রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা দেওয়ার কথা বলেও শেষ পর্যন্ত অনিবার্য কারণ এং শারীরিক দুর্বলতার জন্য তিনি সংবর্ধনা দিতে পারলেন না। কিন্তু তার জন্য সুভাষচন্দ্রের যে মূল্যায়ণ তিনি ২১ জানুয়ারি শান্তিনিকেতনে স্বাগত ভাষণে করেছিলেন তা থেকে তিনি কখনো পিছু হঠেননি। সেই ভাষণে তিনি প্রকাশ্যে বললেন, সুভাষচন্দ্রকে আমি রাষ্ট্রনেতা রূপে স্বীকার করেছি মনে মনে। অসুস্থ শরীরেও তিনি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়েছেন সুভাষচন্দ্রের অন্তর্ধানের সংবাদ পেয়ে। এমনকী আরও জানা যায় তিনি সচিব অনিল চন্দকে পাঠিয়েছিলেন কলকাতায় শরৎচন্দ্র বসুর কাছে বিস্তারিত সংবাদের জন্য। ১৯৩৩ সালে ‘একটি আষাঢ়ে গল্প' নামক ছোটগল্পে কাহিনী অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখলেন, 'তাসের দেশ'। উৎসর্গ করলেন, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে।
জানুয়ারি মাসের ১৯৩৯ সালে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বোলপুরের শান্তিনিকেতন আম্রকুঞ্জে কংগ্রেসের সভাপতি সুভাষচন্দ্র কে সম্বর্ধনা জানান। কবি তখন বলেছিলেন, "কল্যাণীয় শ্রীমান সুভাষচন্দ্র স্বদেশের চিত্তে নতুন প্রাণ সঞ্চার করবার পুণ্যব্রত তুমি গ্রহণ করেছ। সেই কথা স্মরণ করে তোমার নামে তাসের দেশ নাটিকা উৎসর্গ করলাম। আজ তরুণ বাংলা তথা ভারতের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক সুভাষচন্দ্র। আজ র্নিভিক প্রাণে সংগ্রামের মন্ত্র দিতেছেন" ।
উৎসর্গ পত্রে লিখলেন, 'কল্যাণীয় শ্রীমান সুভাষচন্দ্র, স্বদেশের চিত্তে নতুন প্রাণ সঞ্চার করবার পুণ্যব্রত তুমি গ্রহণ করেছ, সেই কথা স্মরণ করে তোমার নামে 'তাসের দেশ নাটিকা উৎসর্গ করলুম। শান্তিনিকেতন, মাঘ ১৩৪৫, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সুভাষচন্দ্রও খুশি মনে তা গ্রহণ করেছিলেন। পরিশেষে বলা যায় রবীন্দ্রনাথের আদর্শ এবং দর্শন সুভাষচন্দ্র তাঁর জীবনে অন্যতম মূলমন্ত্র করেছিলেন। ইতিহাসের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে জানা যায় রবীন্দ্রনাথ এবং সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক মতাদর্শ সবসময় এক মতে থাকত না। তাঁর রাজনৈতিক জীবন জুড়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তাঁরা পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, স্নেহশীল ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সুভাষচন্দ্রের জীবনের ব্যবহারিক এবং রাজনৈতিক বিচক্ষণতার প্রশংসা করে লিখেছিলেন, 'অত্যন্ত বিরক্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়িয়াও তুমি কৈ ধৈর্য ও মর্যাদাবোধের পরিচয় দিয়াছ তাহাতে তোমার নেতৃত্বের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের উদ্রেক হইয়াছে। আত্মসম্মান রক্ষার জন্য বাংলাকে এখনো সম্পূর্ণরূপে ধীরতা ভদ্রতাবোধ অব্যাহত রাখিতে হইবে, তাহা হইলেই আপাতদৃষ্টিতে যাহা তোমার পরাজয় বলিয়া মনে হইতেছে তাহাই চিরন্তন জয় পরিণত হইবে। আমাদের সকলের নেতাজি, আমাদের দেশনায়ক সারাটা জীবন মাথা উঁচু করে দেশসেবার মতো মহৎ কাজ করে। গেছেন। দেশমাতৃকাই তাঁর একমাত্র অস্তিত্ব। তাঁর চেতনায়, আবেগে ও ভালোবাসায় দেশমাতৃকার বন্দনা আজও ধ্বনিত হয়।
কংগ্রেসের সভাপতি পদের জন্য ১৯৩৯ সালে যেই জটিলতা হয় তাহা সমাধানের জন্য ঠাকুর গান্ধীজিকে লিখলেন -"প্রিয় মহাত্মাজী বিগত কংগ্রেস অধিবেশনে অশোভন জেদের বশবর্তি হয়ে কিছু রূঢ় প্রকৃতির মানুষ বাংলাকে গভীর ভাবে আঘাত দিয়েছে। আপনার করুণা ভরা দুটি হাতের স্পর্শে সত্বর এই ক্ষতের উপশম করুন এবং ক্ষত যাতে মারাত্মক হয়ে না ওঠে তার প্রতিবিধান করুন"। মহাত্মা গান্ধীজী সেই চিঠি পেয়ে বিপাকে পরে ধরি মাছ না ছুঁই জল নীতি গ্রহণ করলেন। গান্ধীজী উত্তরে লিখলেন, প্রিয় গুরুদেব আপনার স্নেহপূর্ণ পত্র পেয়েছি। .... সমস্যার সমাধান কঠিন। আমি সুভাষ কে এ বিষয়ে যা কিছু বলবার বলেছি।
Read More
নারী শিক্ষার প্রসারে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা | Vidyasagar in Women's Education in Bengali | Point Bangal
আজ বিদ্যাসাগরের প্রতি যাঁরা শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন তাঁদের অনেকেই "মা কালীর পুজো করে ডাকাতি করার মতলব করছেন"। সেই ডাকাতি আমার আপনার ভাবনার ঘরে ডাকাতি। অতএব সাবধান।